তলাবায়ে কেরাম যেন নিজের ‘শুরু’ না ভোলেন


মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[তালীমী সালের শুরুতে বছর শুরুর সাথে প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা কয়েক বার তলাবায়ে কেরামের সামনে পেশ করা হয়েছে। বিগত শাওয়াল ও যু’কাদাহ সংখ্যাগুলোতে ইনশাআল্লাহ ঐ সব আলোচনা পাওয়া যাবে। চিন্তা করলে, বর্তমান লেখাটিও বছর-শুরুর সাথে প্রাসঙ্গিক।-আব্দুল মালেক]

যেকোনো বিষয়ের শুরু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা গোটা বিষয়ের ভিত্তি ও বুনিয়াদ। কিন্তু বাহ্যিকভাবে সাধারণ হওয়ার কারণে অনেক সময় সে বিষয়ে অবহেলা করা হয়। যা নেয়ামতের না- শোকরী ও মুহসিনের না-কদরী হওয়ার কারণে অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে যায়।

সূচনার গুরুত্বের দলীল তো অনেক। আমি শুধু ঐ মশহূর হাদীসটি উল্লেখ করছি, যাতে ইরশাদ হয়েছে-

من سن سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها بعده إلى يوم القيامة من غير أن ينقص من أجورهم شيء، ومن سن سنة سئية فله وزرها ووزر من عمل بها بعده إلى يوم القيامة من غير أن ينقص من أوزارهم شيء.

অর্থাৎ যে একটি সুন্দর রীতির প্রবর্তন করে সে তার ছওয়াব এবং কিয়ামত পর্যন্ত ঐ রীতির অনুসারীদের ছওয়াব পাবে অথচ পরবর্তীদের ছওয়াব বিন্দুমাত্র কম করা হবে না। (তদ্রূপ) যে কোনো মন্দ রীতির প্রবর্তন করে সে তার পাপ এবং কিয়ামত পর্যন্ত ঐ রীতির অনুসারীদের পাপ বহন করবে। যদিও উত্তরসূরীদের পাপ বিন্দুমাত্র কম করা হবে না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০১৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৯২০২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৪৭৭; তবারানী, হাদীস : ২৪৪৭

তালিবে ইলমের তালীম-তরবিয়াতের শুরু যাঁদের মাধ্যমে হয়েছে ও যেখানে হয়েছে তারা একটি পুণ্যকর্মের সূচনা করেছেন। আর যাদের দ্বারা কোনো পুণ্যকর্মের সূচনা হয় আল্লাহর কাছে তাদের  মর্যাদা অনেক বেশি। সুতরাং বান্দারও কর্তব্য তাদেরকে মর্যাদা দেওয়া।

তারা তো ইহসান ও অনুগ্রহকারীদের মাঝে শামিল থাকার কারণে শোকরগোযারির হক্বদার। উপরন্তু ভিত্তি ও বুনিয়াদ হওয়ার কারণে তাদের আরো অধিক হক্ব সাব্যস্ত হয়। একারণে এর নাকদরী ও না- শোকরী বড়ই ক্ষতির কারণ।

এই না-কদরীর একটি মন্দ দৃষ্টান্ত হল, তালিবে ইলম নিজে তার সূচনা কেটে দেওয়া। তো যে তার জীবনের ‘শুরু’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সে তো জীবনকে শিকড়হীন করল, নিজের সনদ বিলুপ্ত করল, নিজের ইতিহাসকে অসম্পূর্ণ করল এবং জীবন-গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠাগুলোই ছিড়ে ফেলল। এই আচরণকে আপনি কী বলবেন? উদাসীনতা? অহংকার? হীনতা? বস্ত্তত এই সকল কুপ্রবৃত্তির সমষ্টিই হচ্ছে না-শোকরি। একারণে এর সর্বনিম্ন শাস্তি (আল্লাহ মাফ করুন) নেয়ামত ছিনিয়ে নেওয়া। নেয়ামত ছিনিয়ে নেওয়ার অদৃশ্য রূপ হচ্ছে নেয়ামতের বরকত ও উপকারিতা বিলুপ্ত হওয়া।

আসাতিযায়ে কেরামের সম্মান, তাঁদের কদরদানী ও শোকরগোযারী, তাদের প্রতি মহববত ও ইতাআত এবং রুচি, চিন্তা ও আদব-আখলাকের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুকরণ এক যমানায় কওমী মাদরাসার তালিবানে ইলমের শিয়ার বা পরিচয়-চিহ্ন ছিল। এখন ঐসকল বৈশিষ্ট্য আশংকাজনকহারে হ্রাস পাচ্ছে। এখন হয়তো বাহ্যিক ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু কদরদানী, শোকরগোযারী, আদব-আখলাক ও আফকার-মিযাজে অনুকরণের বিষয়ে দুঃখজনক পর্যায়ে ঘাটতি এসে গেছে। আর এক্ষেত্রেও সাধারণভাবে বেশি অবহেলা নিজের প্রথম জীবনের শিক্ষক ও মুরবিবদের সাথে হয়ে থাকে, যা অনেক বিচারে বেশি ভয়াবহ।

এটি একটি দীর্ঘ বিষয় এবং তা হক্ব আদায় করে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়; এজন্য আপাতত‘সূচনাকে ভোলা’র কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই লেখাটি সমাপ্ত করব। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাযত করুন।

১. সম্পর্ক না-রাখা

যাঁর বা যাঁদের কাছে কিংবা যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়েছে সেখান থেকে আসার পর আর সম্পর্ক না-রাখা; আসা-যাওয়াও নেই, চিঠি পত্রের আদান-প্রদানও নেই, না নিজের অবস্থা সম্পর্কে অবগত করা হয়, না তাঁদের খোঁজখবর নেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে এটা অনেক বড় বেওফায়ী। এ রকম তালিবে ইলম সম্পর্কেই কোনো সংবেদনশীল ব্যক্তি বলেছিলেন-

شاگرد ايں زمانہ وقت سبق يگانہ * چوں شد سبق ميسر آرند صد بهانہ

এ যুগের ছাত্ররা সবকের সময় আপন, আর যেইমাত্র সবক সমাপ্ত অমনি শত বাহানা হাজির।

এই পংক্তিও পুরানো হয়ে গেছে। একারণে বর্তমান সময়ের সঠিক চিত্র এতে নেই। এখন তো সবকের সময়ও অনেকে ‘অচেনা-আজনবি’ থেকে যায়।

যা হোক, নিজের ইলমী ও আমলী যিন্দেগীতে বরকতের জন্যও এবং ওফাদারীর দাবি হিসেবেও খোঁজখবর নেওয়া না হোক, অন্তত নিজের অবস্থা সম্পর্কে অবগত রাখা উচিত কী করছি, কোথায় দাখেলা নিয়েছি, তালীমী মুরববী কে ইত্যাদি। বিশেষত, উস্তাদ যদি চিন্তিত থাকেন, অবস্থা জানতে চান এবং খোঁজখবর না পেলে পেরেশান থাকেন। এক্ষেত্রে তো এই হক্ব আরো শক্তিশালী হয়ে যায়।

২. অনুমতি ছাড়া মাদরাসা পরিবর্তন

যাঁদের কাছে ও যে প্রতিষ্ঠানে আমি তালীম হাসিল করছি সেখানে যদি পরবর্তী পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকে তাহলে শরাফতের দাবি, পরবর্তী পড়াশোনাও সেখানে সমাপ্ত করা। এরপর ঐ উস্তাদগণের সাথে মশোয়ারা করে তাঁদের অনুমতি ও সন্তুষ্টি অনুযায়ী অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে যাওয়া। কোনো অসুবিধা বা অপারগতার কারণে আগেই যদি মাদরাসা পরিবর্তন করতে হয় তাহলে সন্তুষ্টি না হোক, অনুমতি তো অবশ্যই নেওয়া উচিত। উস্তাদগণেরও কর্তব্য, তালিবে ইলমের কল্যাণ ও সুবিধাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া এবং মাদরাসা পরিবর্তন যদি তার জন্য কল্যাণকর হয় তাহলে খুশির সাথে অনুমতি দেওয়া।

হযরত পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুম তাঁর নিজের ঘটনা শুনিয়েছেন যে, পাহাড়পুর মাদরাসায় (মুরাদনগর, কুমিল্লা) ঐ সময়ের সর্বশেষ জামাতের পড়াশোনা যখন সমাপ্ত হল তখন আমরা সবাই মাদরাসাতেই বসে ছিলাম যে, উস্তাদগণই ফয়সালা করবেন, আমরা কখন যাব এবং কোথায় যাব। শেষে উস্তাদগণ ফয়সালা করেছেন এবং আমাদেরকে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছেন।

মাদরাসা আরাবিয়া খেড়িহরে এখনও শেষ জামাত মিশকাত। শা’বান ১৪০৭ হিজরীর শুরুতে (১৯৮৭ঈ.) আমাদের অত্যন্ত পেরেশানীর বিষয় এই ছিল যে, ঐ উস্তাদগণের কাছেই দাওরা পড়ার কোনো ব্যবস্থা হল না! আমরা অনেক মিনতি করেছি যে, একবছরের জন্য হলেও দাওরা খুলুন, যেন আমরা দাওরা এখানেই পড়তে পারি। কিন্তু তাঁরা মঞ্জুর করেননি। এটা তাঁদের নীতি যে, ব্যক্তি ও উপকরণের যথেষ্ট ব্যবস্থা হওয়া ছাড়া নতুন কোনো জামাত খোলা হবে না, বিশেষত যখন অন্যান্য বড় মাদরাসার দ্বারা প্রয়োজন পূরণ হচ্ছে। এই ঘটনায় মাদরাসার জিম্মাদারগণের জন্যও এই অনুসরণীয় আদর্শ আছে যে, যথাযথ ব্যবস্থা ছাড়া নতুন জামাত খুলে ছাত্রদেরকে পরীক্ষায় ফেলা ঠিক নয়।

হযরত হারদুয়ী রাহ. থেকে সরাসরি শুনেছি, লোকেরা বারবার বলে যেন এখানে, মাদরাসা দাওয়াতুল হক হারদুয়ীতে দাওরা খুলি। আমরা বলি, ‘ভাই প্রতিষ্ঠান কি কম? দেওবন্দ আছে, সাহারানপুর আছে, ওখানে চলে যাও।’

এখন তো গোটা দুনিয়া থেকে ছাত্ররা দেওবন্দমুখী হয়ে থাকে। কিছু হাসিল করার পরিবর্তে সম্ভবত বরকত গ্রহণের নিয়তই প্রধান হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত বরকত তো হাসিল করার মাঝেই রয়েছে। দেওবন্দি চিন্তা-চেতনাই যদি হাসিল না হয় তাহলে এই কষ্টের ফল কী? যাক্ একসময় তো এটিও ছিল নতুন মাদরাসা। মিশকাতের পর দাওরা পড়ার জন্য কেউ গাঙ্গুহ, কেউ দিল্লী … কিন্তু (হাকীমুল উম্মত) আশরাফ আলী (রাহ.) বললেন, আমাদের কাছে এটা গায়রতের খেলাফ মনে হল যে, এ পর্যন্ত যাঁদের কাছে পড়লাম তাদের কাছে দাওরা পড়ব না! তো দাওরা এখানেই পড়লাম।

গতকালের ঘটনা। এক তালিবে ইলম এসেছেন, তিনি ইফতা বিভাগে দাখেলা নিতে চান। মশোয়ারা চাইলেন, কোথায় দাখেলা নিবেন। তা’লীমী মুরববীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে বললেন, তিনি এ বিষয়ে পরামর্শ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এরপর কথাপ্রসঙ্গে জানা গেল, তিনি হিফয থেকে দাওরায়ে হাদীস এরপর উলূমুল হাদীস একই মাদরাসায় পড়েছেন। আমি তাকে মোবারকবাদ দিলাম এবং আরজ করলাম, অবশিষ্ট তালীমও ওখানেই হাসিল করুন। সামান্যই বাকী আছে। এটার জন্য অন্য কোথাও যেয়ে এই কীর্তির অঙ্গহানী করা থেকে বিরত থাকুন। ওখানে হযরত মাওলানা সাদেকুল ইসলাম ছাহেব আছেন, যিনি হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. এর যমানায় দারুল উলূম করাচীতে ইফতা বিভাগে তালীম হাসিল করেছেন। তাঁর সোহবতকে গনীমত মনে করুন।

জানিনা, আজকাল ছাত্রদের বারবার মাদরাসা পরিবর্তনের এত আগ্রহ কেন। এর একটি বড় দায় তো এই যে, এতে  উস্তাদ অনেক বেশি হয়ে যান, যার ফলে হক্ব আদায়ের পরিধিও অনেক বেড়ে যায়। হক্ব আদায়ের বিষয়ে আমাদের অলসতা ও উদাসীনতা তো এখন অবর্ণনীয়। এরপরও এত হক নিজের উপর কেন আরোপ করছি? উপযুক্ত কারণ ছাড়া আমরা যেন মাদরাসা পরিবর্তন না করি। উপযুক্ত কারণ থাকলেও ইস্তিখারা ও মশোয়ারার পরই যেন পরিবর্তন করি।

৩. ঐ সময়ের তালীমী মুরববীর সাথে সম্পর্ক না রাখা

ছাত্র-জীবনের শুরুতে যাদেরকে আমি তালীমী মুরববী হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা জরুরি। প্রয়োজনে তিনিই বর্তমান সময় হিসাবে অন্য কোনো উস্তাদকে মুরববী বানিয়ে দিবেন বা তাঁর পরামর্শক্রমে আমি কাউকে গ্রহণ করব। কিন্তু সর্বাবস্থায় পুরানো মুরববীর সাথে সম্পর্ক রাখা, খোঁজখবর জানানো, দুআ চাওয়া এমনিতেও জরুরি এবং ওফাদারীরও দাবি।

জুমার দিন বা তালীমী বিরতির দিন যখন কোনো তালিবে ইলম এই অনুমতি চায় যে, তার পূর্বের উস্তাদ ও মুরববীর সাথে সাক্ষাত করতে যাচ্ছে তখন আমার খুব আনন্দ হয়। আমি চাই, নিয়ম নীতির মধ্যে থেকে এই ধারা ছাত্রদের মধ্যে বিস্তার লাভ করুক।

৪. শিক্ষা-জীবনের ইতিহাস বর্ণনার সময় সূচনার উল্লেখ না করা

এটাও বেওফায়ী যে, নিজের শিক্ষাজীবনের ইতিহাস বর্ণনার সময়, নিসবত ও সম্বন্ধ বর্ণনার সময় কিংবা নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় শুধু শেষের দিকের প্রতিষ্ঠানসমূহের কথা বলা এবং ঐ সময়ের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণের নাম উল্লেখ করা। প্রথম দিকের প্রতিষ্ঠান ও উস্তাদগণের কথা বলা থেকে পুরাপুরি বিরত থাকা। আহা! আমাদেরকে ওড়ার উপযুক্ত তো তাঁরাই বানিয়েছেন। বড় উস্তাদদের মজলিসে হাজির হওয়ার তাওফীক কীভাব হয়েছে ও কাদের পরিশ্রমে হয়েছে? যদি মাদরাসায়ে আরাবিয়া খেড়িহরের   উস্তাদগণের মেহনত, শফকত এবং ক্ষমা ও মমতা এ ফকীরের সাথে না হত তাহলে কীভাবে করাচি বিন্নুরী টাউন ও দারুল উলূম কোরঙ্গীর আকাবিরের মজলিসে হাজির হওয়া সম্ভব হত? কিংবা রিয়াদে শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর মজলিসে?

আল্লাহ তাআলা আমার আসাতিযায়ে কেরামকে পূর্ণ জাযা দান করুন। যাঁরা জীবিত আছেন তাদেরকে সুস্থ, সক্ষম ও নিরাপদ রাখুন। প্রশস্ত রিযিক ও বরকতপূর্ণ জীবন দান করুন। আমীন। আর যারা আখিরাতের বাসিন্দা হয়েছেন তাঁদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন এবং আখিরাতের সকল মঞ্জিলে তাঁদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করুন। আমীন।

অনেকে প্রাথমিক পড়াশোনা নিজের পিতা, চাচা বা অন্যকোনো আত্মীয়ের কাছে করে থাকে। অথচ অত্মীয়তার হক্ব ছাড়াও তালীমের জন্য যে আলাদা হক সাব্যস্ত হয় তা চিন্তা করে না। এটাও ভুল, যা সংশোধনযোগ্য।

৫. উস্তাদের সামনে বড় হয়ে যাওয়া

মানুষ যত বড়ই হোক, মা-বাপের সামনে, উস্তাদের সামনে এবং শায়খ ও মুরশিদের সামনে বড় হয় না। কিন্তু অনেক সময় বুঝ-বুদ্ধির স্বল্পতার কারণে আমাদের অনেকের তা স্মরণ থাকে না। অন্য কোথাও না হোক, প্রথমদিকের উস্তাদগণের চেয়ে নিজের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি এসে যায়। আল্লাহ তাআলা এই ব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখুন। এই ব্যাধির বিভিন্ন কারণ রয়েছে :

ক. নিজের অবস্থা সম্পর্কে বে-খবর হওয়া

নিজের দোষ-ত্রুটির তো খবর নেই, উপরন্তু এ বিষয়েও উদাসীন থাকা হয় যে, কিছু যদি হাসিল হয়েও থাকে তা শুধু আল্লাহ তাআলার দান, যার বাহ্যিক মাধ্যম হলেন ঐ আসাতিযায়ে কেরাম এবং তাঁদের দুআ ও তাওয়াজ্জুহ।

খ. উস্তাদগণের কামালাত ও কবূলিয়্যত সম্পর্কে অজ্ঞতা

তথ্যজ্ঞান বা সার্টিফিকেট কম থাকার কারণে (বাস্তবেই যদি কম হয়) নির্বোধ লোকেরা তাদের ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাঁদের কামাল ও যোগ্যতা এবং কবূলিয়ত ও গ্রহণযোগ্যতা অনুমান করতে পারে না এবং ধোকায় পড়ে যায়।

গ. ইসতি’দাদের কোরবানী সম্পর্কে বে-খবর হওয়া

কখনো এমনও হয় যে, প্রাথমিক

স্তরের উস্তাদ তাঁর নিজের বিষয়ে (প্রাথমিক শিক্ষা বা বিশেষ কোনো শাস্ত্রের অধ্যাপনায়) ইমাম হয়ে থাকেন। ঐ বিষয়ে তাঁর সংস্কারক-সূলভ যোগ্যতা থাকে, কিন্তু ছাত্ররা তাদের অনভিজ্ঞতা ও‘দৃষ্টিহীনতা’র কারণে তাদের ঐ যোগ্যতার মূল্য বোঝে না। তাঁদের সাথে ঐ ভক্তি-শ্রদ্ধা ও অনুসরণ-অনুকণের আচরণ করে না যার তারা উপযুক্ত। কারণ তাঁদেরকে তো শায়খুল হাদীস বা শায়খুত তাফসীরের মসনদে দেখা যাচ্ছে না! তারা চিন্তা করে না যে, এমন মাহির ব্যক্তিরা যদি উপরের দিকের ইলম ও ফন্নের তাদরীসকে নিজেদের মাশগালা বানাতেন তাহলে তারা শায়খুল হাদীস নয়, শায়খু শুয়ূখিল হাদীস হয়ে যেতেন এবং ঐ অঙ্গনেও নিজেদের যোগ্যতা ও বিশিষ্টতা প্রমাণ করতেন। তাঁরা ‘বিলফেল’ যদিওবা শায়খুল হাদীস নন কিন্তু হতে পারে ‘বিলকুওয়াহ’শায়খুল হাদীসেরও অনেক উপরে তাদের স্থান।

তো এধরনের আরো অনেক কারণ আছে, যা নিজেদের প্রথম-জীবনের আসাতিযার প্রকৃত অবস্থান ও মর্যাদা উপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে। এই সকল ভুল ধারণা দূর করে নিজের সংশোধন অতি জরুরি। তাঁরা তো নিজেদের এই দিকের যোগ্যতা ও ইসতিদাদের কুরবানী দিয়েছেন এবং যে অঙ্গনে বেশি দৈন্য ও শূন্যতা অনুভব করেছেন ঐ অঙ্গনকে নিজেদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ কারণে তারা আরো বেশি কৃতজ্ঞতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা পাওয়ার হক্বদার। কিন্তু ছাত্রদের অভ্যাস এই দাড়িয়েছে যে, তারা আদব-তাওয়াজু, ভক্তি-শ্রদ্ধা ও অনুসরণ-অনুকরণকে ঐ সকল        উস্তাদের হক্ব মনে করে যাদের নিকট থেকে উপরের দিকের সবক গ্রহণ করেছে। নিঃসন্দেহে তাঁরা ঐ সব কিছু পাওয়ার উপযুক্ত এবং শুধু গতানুগতিকভাবে নয়, আন্তরিকভাবে এবং অসম্পূর্ণ নয়, পরিপূর্ণভাবে পাওয়ার উপযুক্ত। আমার আপত্তি শুধু বিষয়গুলোকে তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করার উপর। এই সব কিছুর হক্ব তো আমার নিজের ফায়েদার জন্য আমার ঐ সব উস্তাদেরও, যারা আমার ভিত্তি রেখেছেন। তাদের বিষয়ে উদাসীন কীভাবে হই?

তারা তো আমার জন্য শুধু বাবার মতো ছিলেন না, মায়ের মতো মমতাশীল ছিলেন। তারা ঐ বয়সে আমার তরবিয়ত করেছেন যখন আমার বুদ্ধি ছিল না; বিচার-ক্ষমতা ছিল না, আমি নিজে নিজে পড়ার ও শেখার উপযুক্ত ছিলাম না। ঐ সময়ের তরবিয়ত যে কত কঠিন ও ধৈর্যপরীক্ষক হয়ে থাকে তা তো শুধু সংবেদনশীল পিতা-মাতাই জানেন।

৬. আচার-আচরণে অবহেলা

সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় এই যে, ঐ উস্তাদগণের সাথে চালচলন ও আচার-আচরণে এমন কিছু প্রকাশ পাওয়া, যা থেকে বোঝা যায়, অন্তরে তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার অভাব রয়েছে। বাস্তবেই এমন কিনা তা এভাবে পরীক্ষা করা যায় যে, তালিবে ইলম নিজের উপরের দিকের উস্তাদদের সাথে নিজের আচার-আচরণ লক্ষ্য করবে। যদি দেখা যায় তাদের সাথে এরকম আচরণ করা হয় না তাহলে বুঝতে হবে, আগের উস্তাদদের সাথে এ আচরণ এজন্যই প্রকাশ পেয়েছে যে,-আল্লাহ মাফ করুন-তাঁদের যথেষ্ট ভক্তি-শ্রদ্ধা অন্তরে নেই। এই অবস্থা, আগেও বলেছি, অত্যন্ত মারাত্মক। আমার কোনো আচরণে যদি আমার উস্তাদের মনে এই ওয়াসওয়াসা আসে যে, আমি যদি এই ছেলের হেদায়াতুন্নাহুর উস্তাদ না হয়ে হিদায়ার উস্তাদ হতাম, আততরীক ইলাল আরাবিয়্যাহর পরিবর্তে ‘মাকামাত’-এর, আলফিয়াতুল হাদীসের পরিবর্তে বুখারীর কিংবা মকতবের পরিবর্তে কিতাবের উস্তাদ হতাম তাহলে সে আমার সাথে এমন আচরণ করত না। কোনো সন্দেহ নেই, এটা একজন ছাত্রের জন্য চরম ক্ষতির কথা এবং নির্বুদ্ধিতা ও অসভ্যতার স্পষ্ট নিদর্শন।

প্রথমত, দরসের এই তারতম্য বাস্তবতার মাপকাঠি নয় যে কামাল, ফযীলত ও কবূলিয়াতের মধ্যে কে আগে, কে পিছে। দ্বিতীয়ত, উস্তাদের হক্ব সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এইসব পার্থক্যের কোনো প্রভাব নেই। উস্তাদের হক্ব এভাবে সাব্যস্ত হয় যে, আমি তার ছাত্র হয়েছি কিনা। কী পড়েছি, কতটুকু পড়েছি তা মুখ্য বিষয় নয়। তৃতীয়ত, অধিক মেহনত ও অনুগ্রহ তো তাদের যারা আমার বুদ্ধিহীনতার সময় আমার পেছনে মেহনত করেছেন। তো অগ্রগণ্যতার কারণকে আমি নগণ্যতার কারণ কীভাবে সাব্যস্ত করি?!

আপাতত এ কয়েকটি কথা আরজ করেই সমাপ্ত করছি। আগেই বলেছি, বিষয়টি দীর্ঘ ও নাযুক। আমার দরখাস্ত, আল্লাহর কোনো কামিল ও মকবুল বান্দা এ বিষয়ে কলম ধরুন এবং আমাদের মতো তালিবানে ইলমের রাহনুমায়ী করুন। আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে জাযায়ে খায়ের দান করবেন আমীন।

আমি আমার সকল তালিবে ইলম ভাইয়ের কাছে দরখাস্ত করছি, আল্লাহ তাআলা আমাকে আমার সকল উস্তাদের হক্ব ও আদব রক্ষা করার তাওফীক দান করুন এবং এ পর্যন্ত যাদের হক্ব আদায়ে আমার পক্ষ থেকে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে আল্লাহ তাআলা তার অনিষ্ট থেকে আমাকে ও আমার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে রক্ষা করুন এবং আমার আসাতিযার অন্তরকে এই অযোগ্য শাগরিদের বিষয়ে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করে দিন। আমীন। ষ

৮/৯/১৪৩৩ হিজরী

নিজের ইলমী মারকাযের সাথে সম্পর্ক রাখার গুরুত্ব এবং আদাবে ইসলামিয়ার উপর কাজ করার প্রয়োজনীয়তা-২


মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[২৭ শাবান ১৪৩১ হিজরীতে

হাইআতু আবনাইল জামিয়ার (জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা) মজলিসে প্রদত্ত বয়ান।]

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কীভাবে আদব আসবে?

আদবের জন্য ‘আকল’ দরকার। আকলে সালীম ও তাজরেবার (সুস্থ বিবেকবুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার) দরকার। সোহবতের দরকার আর ইলমের দরকার। আদব জানতে হবে কুরআন-হাদীস থেকে, সীরাতে সাহাবা থেকে, হায়াতুস সালাফ থেকে। আদাবে ইসলামিয়ার মাওয়াদ তো প্রচুর। সব মাওয়াদ তো সবার জমা করা মুশকিল হবে।

আমরা সবাই আদবের উপর মুতালাআ করব। কুরআন মাজীদ থেকে, হাদীসের কিতাব থেকে, সীরাতের কিতাবে, হায়াতুস সালাফের কিতাবে। যার কাছে যেটা থাকে। অন্তত থানভী রাহ.-এর ‘আদাবুল মুআশারাত’তো থাকবে। ‘আদাবে জিন্দেগী’ নামে, চার-পাঁচটি রিসালাহর একটা মাজমূআ আছে। ঐগুলো তো থাকবে। হায়াতুল মুসলিমীন, তালীমুদ্দীন তো থাকবে। এগুলো থেকে পড়ি। মেশকাত আর দাওরায়ে হাদীসের কিতাবে যে কিতাবুল আদাব আছে তা পড়ি, বিশেষ করে তিরমিযী শরীফের কিতাবুল আদাব। অন্তত‘মেশকাতে’র  কিতাবুল আদাব।

হাদীস শরীফের মুতালাআর প্রতি অবহেলা

এই যে আমাদের মহা মুসীবত, হাদীসের কিতাব যখন পড়ে যাই তখন হাদীসের কিতাবের সাথে সম্পর্ক। এরপর কোনো মাদরাসায় হাদীসের কিতাবের দরস দিলে আবার হাদীসের কিতাবের সাথে সম্পর্ক; আর দরস না দিলে সম্পর্ক নেই। খালি দরসের দায়ে পড়া; পড়তে তো হবে পড়ার মহববতের জন্য, পড়ার জরুরতের জন্য। আমি মনে হয় আমার তালিবে ইলম ভাইদের সাথে আলোচনাও করেছি যে দরসী মুতালাআ হল এক নাম্বার।

তবে এই দায়িত্ব পালনের পর আমি আধাঘন্টা সময় বের করতে পারি অন্য ইযাফী মুতাআলার জন্য। ইযাফী মুতাআলার কি শেষ আছে?

ক. দায়েমী মুতালাআ

খ. মাওযূভিত্তিক মুতালাআ

গ. মৌসুমী মুতালাআ

তিনটি মুতলাআ। এটা সব তালিবে ইলমের থাকতে হয়। অল্প সময় বের করেও হোক না কেন।

মৌসুমী মুতালাআ

রমযান আসল। রমযানের সিয়ামের মাসায়েল, ক্বিয়ামূল লাইল, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের মাসায়েল। ইতিকাফের মাসায়েল, ঈদুল ফিতরের মাসায়েল, সাদাকাতুল ফিতরের মাসায়েল। কতগুলো মাসায়েল। এগুলো যিন্দেগীতে একবার মুতালাআ করেছি, তার উপর ইকতিফা করব কেন?

এই মওসুম এসেছে, একবার নতুন করে বেহেশতী যেওরে মাসআলাগুলো দেখে নিই! হাদীসের কিতাব আমার কাছে যেটা আছে সেখান থেকে একবার পুরো কিতাবুস সওম পড়ি। ইলম তাজা হবে। এভাবে যে বিষয়ের মৌসুম ঐ বিষয়ের উপর আমি মুতালাআ করি। মুতালাআ তাজা করি।

বিষয়ভিত্তিক মুতালাআ

বিষয়ভিত্তিক মুতাআলা তো এক বিশাল সমুদ্র। তাওহীদের উপর মুতালাআ দরকার। সুন্নত-বিদআতের উপর মুতালাআ দরকার। এই যে আদাবুল মুআশারা, ছফায়ে মুআমালা-এর একেক শাখা কত লম্বা। কিন্তু লম্বা হলেও এগুলোর উপর আকাবিরদের রিসালা আছে। আমি উস্তাযের সাথে মশওয়ারা করে নির্বাচিত দু’তিনটি রিসালাহ ইনতিখাব করি। শুধু সেটাই মুতালাআ করি।

সামর্থ্য অনুযাযী গড়ে তুলি কুতুবখানা

প্রত্যেক তালিবুল ইলমের কাছে একটি কুতুবখানা থাকা লাগবে। তোমাদের

উস্তাযদের কাছ থেকে শিখ। দেখ, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে নির্বাচিত কিছু কিছু কিতাব আছে এবং যা আছে তার চেয়ে বেশি মুতালাআ। তালিবে ইলমের যামানা থেকে, মালিবাগে থাকতে। দেওবন্দের যামানায়, দেওবন্দ থেকে আসার পর এবং এখনও।

ইলমকে হালের সাথে মিলিয়ে হালনাগাদ রাখতে হবে। কী যেন বলে আপডেট?, হালতের মুওয়াফেক রাখতে হয়। আপনার মুতালাআ হল পঞ্চাশ বছর আগের। যামানা এখন পঞ্চাশ বছর এগিয়ে গেছে-এটা হবে নাকি? মুতালাআ সবসময় জারি রাখতে হয়, বা-খবর থাকতে হয়। সেটার জন্য এক উপায় হল, নিজের কাছেও কুতুবখানা থাকতে হয়। বলবে, আমার এত স্বচ্ছলতা আছে নাকি? ইস্তেগনা ঠিক রেখে ফকীর মওলবীদেরও বড় বড় কুতুবখানা ছিল।

হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. এর কুতুবখানা

নূমানী রাহ. বয়স বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে যখন বিন্নুরী টাউন থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান তখনও তাঁর বেতন ১৯০০ রুপির মত। এটা ছিল ১৪১২ হিজরী, ১৯৯২ এর কথা। তাছাড়া তিনি আহলে খায়রের মাঝে পরিচিত ছিলেন না যে তাঁর কাছে হাদিয়া-তোহফা আসবে। ডাক্তার আমজাদ নামে একজন সেখানে ছিলেন। ঐ বেচারা কীভাবে খবর পেয়েছিল। ঐ ডাক্তারের ভাগ্নি ও ভাগ্নিজামাই হুযূরের কাছে পড়তে আসত। তাদের‘মাদরাসা আয়েশা’ তে হুযূরকে সবক পড়ানোর অনুরোধ করেন। সেই ডাক্তার আমজাদের ভাগ্নি নূমানী সাহেবের কাছে কিতাবুল আছার, মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাসহ দাওরার সব কিতাব পড়েছে। দৈনিক আসত। সে আর তার স্বামী আসত। পর্দা রক্ষা করে পড়ত। আর ‘মতন’ স্বামীর চেয়ে ভাল পড়ত স্ত্রী। ওরা কিভাবে হুযূরের খোঁজ পাওয়ার পর উমরা করিয়েছে, হয়ত খোঁজ-খবরও রেখেছে। এছাড়া পুরো জীবন অভাবেই গিয়েছে। একজন তাঁকে শিখিয়েছেন হিযবুল বাহর-এর আমল। হুযূর আমাকে শিখিয়েছেন।

হিযবুল বাহরের আমলের পর তাঁর ভাষায়-‘কাভী কাভী তঙ্গী হো জাতি হ্যায়, লেকিন ও ফাক্বাহ ফের নেহী আয়া, এতনা ফাক্বাহ ফের নেহী আয়া।’

এই ছিল হালত। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত কুতুবখানা অনেক প্রতিষ্ঠানের কুতুবখানা থেকে বড় ছিল। কলেবরে যে রকম বড়, দুষ্প্রাপ্যতার (নাওয়াদের-এর) দিক থেকে তো কথাই নেই।

কীভাবে হয়েছে? হুযুরের কাছে গেলে আমাকে বলতেন, ‘‘ক্যায়সে আয়া, বাস পে ইয়া প্যায়দাল আয়ে?’’

কখনো পায়দল যেতাম। তো যেদিন পায়দল যেতাম সেদিন খুশীতে বলতাম, ‘‘জ্বী হযরত! প্যায়দাল আয়া’’। শুনে বলতেন, ‘‘বাহুত আচ্ছা কিয়া’’। যেদিন বাসে যেতাম সেদিন জিজ্ঞাসা করতেন, ‘‘কেতনা লেতা হ্যায় বাস পে?’’

বলতাম, ‘‘হযরত! তীস প্যায়সা’’।

হযরত বলতেন, ‘‘তীস প্যায়সা ভী তালিবে ইলম কে লিয়ে কম নেহীঁ হামারে তীস প্যায়সা হোতে তো জমা কর লেতে অ্যাওর দু চার প্যায়সে হো জাতে তো য়েক রেসালা খরিদ লেতে।’’ এভাবে কিতাব জমা হয়েছে।

বি-বাড়িয়া টান বাজার মসজিদের খতীব দারুল উলূম দেওবন্দ থাকাকালে মাতবাখ থেকে দুই রুটি পেতেন। তিনি এক রুটি খেতেন, আরেক রুটি নিয়ে যেত যারা নিয়ে যায়। বিনিময়ে এক পয়সা দিত। তিনি এভাবে পয়সা জমা করে রাসায়েল কিনেছেন। এখনও যিন্দা আছেন।

এরকম ইস্তিগনার সাথে। ইস্তিগনার প্রসঙ্গ কেন আনলাম? একদিন বাংলাবাজার বা চকবাজার গিয়েছি কিতাব কিনতে। একজন লোক খোঁজ করছে ‘ইসলাহী খুতুবাত’ বা অন্য কোনো কিতাব। কি জন্য খোঁজ করেছে সে? নিজের পড়ার জন্য না বোঝা-ই যায়। বলল, আমাদের ইমাম সাহেব বলেছেন, তাঁর বয়ানের জন্য এই কিতাবটা দরকার। তার বলার আন্দাযে, যেভাবে বলছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, সন্তুষ্টচিত্তে (শরহে ছদর) এর সাথে দিচ্ছে না। এবং তার (ইমাম) বলার আন্দাযও হয়ত ঠিক হয়নি।

এভাবে নয়। আমার কুতুবখানা এভাবে সংগ্রহ হবে না। কিতাব সংগ্রহ হবে নূ’মানী রাহ.-এর মত, টান বাজার মসজিদের খতীব সাহেবের মত। কুতুবখানা সংগ্রহ হবে আমীন সফদারের মত।

মাওলানা আমীন সফদার রাহ.

মাওলানা আমীন সফদার রাহ. তো আরো ফকীর ছিলেন। কিন্তু তাঁর কুতুবখানায় ছিল আনদারুন নাওয়াদির, দুর্লভ বিভিন্ন রিসালা ও কিতাব। আমাদের মত মাসাদেরের ইন্তেযামের তো প্রশ্নই আসে না। ও-রকম তো ছিলই না। তাঁরা কয়েক কিতাবের কাজ হয়ে যায় এমন কিতাব সংগ্রহ করতেন। আদ্দুররুল মানছূর, জামিউল উছূল, কানযুল উম্মাল এরকম কিতাব সংগ্রহ করতেন।

একবার তাঁর আদ্দুররুল মানছূর-এর দরকার হলো। রাতে তাহাজ্জুদ তো পড়তেন-ই। ঘরের সামনে ছোট্ট বাগান আছে, সেখানে নামায পড়ে দুআ’ করলেন-আল্লাহ, আমার কিতাবের

ইন্তেযাম করে দাও।

এমন কান্নাকাটি করলেন, কাঁদতে কাঁদতে ঘুম এসে গেল। স্বপ্নে দেখেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ এনেছেন। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘য়ে ভী মিল জায়েগী, আগে কিতাব কে লিয়ে তুমহে তাকলীফ না হোগী’’ যে কিতাব চেয়েছো সেটাও তুমি পেয়ে যাবে। সামনে আর কিতাবের জন্য তোমার কষ্ট হবে না। পরের দিনই আদ্দুররুল মানছূর-এর ইন্তেযাম হয়ে গেছে। এরপর তো আমরা দেখতাম, বিন্নুরী টাউনে যখন তিনি ছিলেন; সৌদী থেকে কেউ আসল, অমুক জায়গা থেকে কেউ আসলম্ন কয়েকটা কিতাব নিয়ে আসল-হুযুর আপনার জন্য এনেছি। এভাবে ইসতিগনার সাথে চললেও কিন্তু সম্ভব। অর্থস্বল্পতা সত্ত্বেও যদি আগ্রহ থাকে আর আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে থাকি, রোনাযারী করতে থাকি তাহলে কুতুবখানা হতে পারে।

কেমন হবে কুতুবখানা

মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ’র ভাষায় কুতুবখানা শিশু কুতুবখানা হোক, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ হতে হবে। শিশু ছোট্ট কিন্তু সব আছেপ্তপ্ত নাক, চোখ, কান-সবই তো আছে। আমার শিশু কুতুবখানা আস্তে আস্তে একদিন বড় হবে। প্রথম থেকে কিতাবের পরিমাণ বাড়ানোর চেয়ে চেষ্টা করব পূর্ণাঙ্গ করার। জরুরি যত বিষয় আছে সব বিষয়ে তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ রিসালাহ নির্বাচন করে একটি করে কিতাব বা রিসালাহ সংগ্রহ করব।

তাফসীরের আর কোনো কিতাব নেই, তো অন্তত তাফসীরে উসমানী আর তাফসীরে ইবনে কাসীর থাকুক। আরেকটু সচ্ছলতা এলে তখন মাআরিফুল কুরআন সংগ্রহ করি। কিন্তু মাআরিফুল কুরআন-এর আগে যেহেতু তাফসীরে উসমানী আছে তাহলে এখন মাআরিফুল হাদীস বা রিয়াযুস সালেহীন সংগ্রহ করি। মাদরাসায় পড়েছি, মাদরাসায় কিতাব থেকে গেছে। আমার কিতাব কোথায়? দায়েমী মুতালাআর জন্য কিছু কিতাব তো সবসময় থাকতে হবে আমার কাছে।

দায়েমী মুতালাআ

এটা হল ঈমান হেফাযতের জন্য, ঈমান তাজা রাখার জন্য। এই মুতালাআ আপনি করুন কুরআন মজীদ থেকে, দৈনিক দশ মিনিটই হোক। কুরআন মজীদ মুতালাআ করি, সীরাত এবং হাদীস মুতালাআ করি দশ মিনিট। দশ মিনিট মুতালাআ করি হায়াতুস সাহাবা এবং হায়াতুস সালাফ।

কুরাআন মজীদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক আমার হতে হবে। কিন্তু সরাসরি সম্পর্ক আমি যতই কায়েম করি আমার সালাফ সেখান থেকে যা নিতে পেরেছেন আমার নযর, বাছীরাত ঐ পর্যন্ত পৌঁছবে না। সে জন্য তাঁদের সাওয়ানেহে হায়াত, মালফুযাত ও মাকতূবাত মুতালাআ করা মানে এক পর্যায়ের কুরআন-সুন্নাহর তালীমাত মুতালাআ করা। তবে এর অর্থ এই নয় যে, কুরআন-সুন্নাহ সরাসরি মুতালাআ করব না। সরাসরি মুতাআলা তো অবশ্যই করতে হবে। এটা আমাদের বড় দুর্বলতা-আমরা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর মুতালাআ কম করি। কুরআনের সাথে তেলাওয়াতের সম্পর্কের পাশাপাশি ‘মুতালাআয়ে কুরআনের’ সম্পর্ক কায়েম করার চেষ্টা করব। সুন্নাহ মুতালাআর চেষ্টা করব। তাহলে ইনশাআল্লাহ মুতালাআর মাধ্যমে আমার ঈমানও তাজা থাকবে, কাজও হবে।

কিতাব কীভাবে তৈরি করব?

কথা তো দূরে চলে গেল। বলছিলাম, আমরা আল-আদাবুল ইসলামিয়ার উপর কিতাব তৈরি করব। এটার জন্য খুত্তা বানাতে হবে। আল-আদাবুল ইসলামিয়ার কয়টা বাব, প্রত্যেক বাবে কয়টা ফসল, কী কী শিরোনাম আসবে। খুত্তা বানানোর জন্যও তো দু ধরনের মুতালাআ লাগবে- খুসুসী মুতালাআ, উমুমী মুতালাআ। খুসূসী মুতালাআর জন্য আপাতত যেহেনে এসেছে ইবনে মুফলিহ রাহ.-এর কিতাব আল-আদাবুশ শরইয়্যাহ। এটা একটু বড় কিতাব। এর চেয়ে ছোট এক জিলদের কিতাব আছে আবুল হাসান মাওয়ারদী রাহ.-এর আদাবুদ দুনইয়া ওয়াদ দ্বীন। আর ইমাম বুখারী রাহ.-এর আল-আদাবুল মুফরাদ। আর তাছাড়া হাদীসের কিতাবের কিতাবুল আদাব। আবার আল-আদাবুল ইসলামিয়ার অনেক মাসআলা কিতাবুল আদাবের শিরোনাম ছাড়াও পাওয়া যায়। যুহদ, আদাবে যাহেরার পাশাপাশি এতে অন্যান্য আদাবে বাতেনা আসবে। যদিও সেগুলোর তাফসীল কম হবে। আদাবে যাহেরার তাফসীলটা বেশি হবে। এই জন্য হাদীসের কিতাবের কিতাবুল আদাব দেখব। বিশেষভাবে তিরমিযী শরীফের কিতাবুল আদাব দেখব। আর ইমাম বুখারী রাহ.-এর আলআদাবুল মুফরাদ সংগ্রহ করব। রাসায়িলের মধ্যে আছে থানভী রাহ. এবং অন্যান্য বুযুর্গদের রিসালাগুলো।

মিন আদাবিল ইসলাম

শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর রিসালাহ আছে মিন আদাবিল ইসলাম। অনেক কিছু আছে এই কিতাবে। শায়খ তো কথা শুরুই করেছেন আবু দাউদ শরীফের হাদীস দিয়ে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৮৬) রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সিয়াক ও সাবাক থেকে বোঝা যায়) সম্ভবত কোনো এক সফর থেকে ফেরার সময়  সাথীদেরকে বলেছেন-

إنكم قادمون على إخوانكم فأصلحوا رحالكم وأصلحوا لباسكم حتى تكونوا كأنكم شامة في الناس

এই হাদীসে ফিকির করলে কত কিছু বের হয়। সফর থেকে ফেরার সময় সাধারণত মানুষের মানসিকতা থাকে, আগে ঘরে যাই, তারপর গোসল করব, কাপড় পাল্টাব, সব করব। কিন্তু রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, তুমি মদীনায় দাখেল হওয়ার আগে এখানে মনযিল করেছ, এখন এই মনযিলেই সব ঠিকঠাক করে নাও। কাপড় পরিবর্তন কর বা ধুয়ে পরিষ্কার কর। সফরের কারণে উটের পিঠের হাওদাজে সামানাগুলো যে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে সেগুলো ঠিক কর, গোছগাছ কর। তখন দেখা যাবে, সবাই তাকালে ভাল লাগবে। নেক মানযার দেখলে, ভাল দৃশ্য দেখলে ভাল লাগে।

شامة في الناس  কিসের জন্য? রিয়ার জন্য নাকি? ‘‘ইরাহাতুল খালক’’-এর জন্য। এটা দ্বিতীয় মাকসাদ। প্রথম মাকসাদ হল ইসলামের সহীহ তরজুমানী করা। আমি মিন আবনাইল ইসলাম, দেখ ইসলামের তারীফ, ইসলাম এমন মাযহার পছন্দ করে।

আমরা সবাই ইসলামের তারজুমান

আমরা আসলে সবাই তারজুমানী করছি ইসলামের। আমার ঘরে, ঘরের বাইরে। আমার মাদরাসা, আমার মসজিদ- আমি যেখানে আছি- অফিস-আদালতে আছি, আসলে মুসলমান সবাই তো ইসলামের তারজুমানী করে। বিশেষভাবে মানুষ যাদেরকে উলূমে ইসলাম ও ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহক মনে করে তারা তো অবশ্যই তারজুমান। খালি যবানের বয়ান তারজুমান নাকি? আমার সবকিছুই তো তারজুমান। আমার আখলাক, আমার আদাব, আমার মাযহার, আমার আচার-আচরণ, লেবাস-পোশাক, সবকিছুই তারজুমান। আমার দ্বারা যেন দ্বীনের সহীহ তারজুমানী হয়।

আদবের আরেকটি কিতাব

মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার কিতাবুল আদবও আমি বলব, যাদের কাছে আছে। সবার কাছে এক কিতাব থাকতে হবে- তা জরুরি নয়। কিন্তু এক-দুইটা সবার কাছে থাকতে হবে। যেমন ইমাম বুখারী রাহ.-এর আলআদাবুল মুফরাদ। আকারে ছোট। তাসবীর করিয়ে নিতে পারি, আর এমনিতেও পাওয়া যায় এখন। আবুল হাসান মাওয়ারদী রাহ.-এর কিতাব আদাবুদ দুনইয়া ওয়াদ দ্বীন। এখন সেটাও পাওয়া যায়। আলআদাবুশ শরইয়্যাহ একটু বড়। আমরা চার-পাঁচজন মিলে তার ইন্তেযাম করতে পারি। পাশাপাশি দাওরায়ে হাদীসের কিতাব থেকে কিতাবুল আদাব খুলি। এ সকল কিতাব সামনে রেখে সাথে যদি বর্তমান নতুন লেখকদের কোন রচনা পাওয়া যায়, এগুলোকে সামনে রেখে আমি একটা খুত্তা তৈরি করব। এভাবে ফিকির করে করে পুরো কাঠামোটা তৈরি করে নিতে হবে।

শিরোনামগুলো প্রথমে বিক্ষিপ্তভাবে লিখে ফেলি, পরে তারতীব দিই। একাধিক খুত্তা তৈরি হতে পারে, কোন সমস্যা নেই।

মুতালাআ কিন্তু সবাই করবে। মুতালাআর হাসিল নোট করবে। যা নোট করবে তার এক নোসখা নিজের কাছে রাখবে আর অপর নোসখা এখানে জমা দিবে।

আর আজ কালের মাঝে আমরা সবাই রোজনামচায় লেখার চেষ্টা করব এই মজলিসে কোন হুযুর কী বললেন। এখান থেকে উঠে গেলে কতটুকু থাকে আল্লাহই জানেন। আল্লাহ করুন, পুরোটাই আসুক। এভাবে নোট করব। আর এখানে তাসজীলের ব্যবস্থা থাকা দরকার। থাকলে এ বয়ানগুলো তাসজীল থেকে নকল করলেই বড় এক যাখীরা তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ।

সামনে আবনাউল জামিআর কার্যক্রম যখন আরও প্রশস্ত হবে তখন শুরুর যুগের হেদায়েত, শুরুর যুগের ইতিহাস একটি নমুনা হবে সামনের আবনাউল জামিয়ার জন্য। সে নমুনা আমরা ফিকির এবং আমলের মধ্যে পেশ করি। ষ

[বয়ানটি মুসাযযিলা থেকে পত্রস্থ করেছেন মুহাম্মাদ হুজ্জাতুল্লাহ।

নযরে ছানীর পর তা প্রকাশিত হলো।]